ফাগুনের আগুন ঝরা বিকেলে বারান্দায় একা বসে আছে শুভ। ওর উদাস দু’চোখ কখনো আকাশের দিকে, আবার কখনো ছোট্র বাগানটার দিকে। না, কোন কিছ্ইু নির্দিষ্ট করে দেখছে না সে। অথচ আকাশটা আজ কী অদ্ভুত রূপ ধারণ করে আছে। তার বিশাল বুকে কোথাও একখন্ড কালো মেঘ পর্যন্ত নেই। স্বচ্ছ সুন্দর আকাশ। পাখিরা দল বেঁধে উড়তে উড়তে এক সময় হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। পরক্ষণে আবারো নতুন পাখির দল...
বাগানটা ছোট হলেও ফুলের অভাব নেই তাতে। গোলাপ, রক্তগোলাপ, জবা, বেলি, গন্ধরাজ ও হাসনাহেনা গাছে যেনো মিছিল করছে ফুলগুলো। না, ফুলের এই মিছিল এবং আকাশও এতোটুকু আকর্ষণ করতে পারেনি শুভকে। আজ কেবলি সে এক চৈতন্যহীন মানুষ। হঠাৎ এমন কেনো হলো- বুঝতে পারছে না সে।
আচ্ছা, নদীও কি শুভ’র দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হবে আজ ? বিষয়টি একটু দেখা দরকার। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় ও। নদীর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই বুকের বাম পাশে একটা চিন চিন ব্যাথা শুরু হলো। পা পেছনে ফেলে চেয়ারে আবারো বসতে বাধ্য হয় সে। নদীর কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। যখন’ই নদী চোখে পড়ে তখন’ই বুকে একটা ব্যথা অনুভূত হয় শুভ’র। এই ব্যথার নেপথ্যে ’নদী’ নামের একটি মেয়ে। যে নর্দীর করাল গ্রাসে শুভ’র হৃদয় ভেঙ্গে চৌচির।
বিকেল গড়িয়ে কখন যে গোধূলী এসে উপস্থিত- টের পায়নি শুভ। হঠাৎ চোখ পড়লো, উঠানের বাম পাশের মুরগীর ঘরটার দিকে। মুরগীর ঘরটা দুপুরের দিকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভেঙ্গেছে শুভ’ই। বাড়ীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয় বলে মুরগী পালন বন্ধ করার জন্যে’ই এই উদ্যোগ। অবশ্য ঘরটা ভাঙতে গিয়ে মা-বোনদের প্রতিরোধের সম্মূখীন হতে হয়েছে বেশ ক’বার। শুভ লক্ষ্য করলো, শূণ্য ভিটাতে’ই বড় আপন করে বসে আছে মুরগীটা। ঘর দুয়ার নিশ্চিহ্ন করা সত্ত্বেও মুরগীটা তার ভিটা ভুলেনি। অভিমান করে কোথাও চলেও যায়নি। তার স্মৃতিকে সে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এ বাড়ীতে সে আড়াই বছর ধরে বসবাস করে আসছে। একই মুনিবের বাড়ীতে আড়াই বছর অতিবাহিত করা মুরগী জীবনের জন্যে অনেক গুলি দিন। দীর্ঘ দিনগুলোতে সে অনেক ডিম দিয়েছে, ফুটিয়েছে বহু ছানা।
খাঁচায় বন্দি করার জন্য শুভ’র মা রাহেলা বেগম মুরগীটা ধরে বসত ঘরে নিতে এসেছেন। মুরগীটা কোথাও যেতে নারাজ। সে তার স্মৃতির ভিটায় থাকতে চায়। দৃশ্যটি শুভকে দারুন ভাবে আলোড়িত করলো। হঠাৎ মুরগীটার প্রতি ওর কেনো যেনো প্রচন্ড একটা ভালোবাসার সৃষ্টি হয়ে গেলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো-মুরগীটার জন্য শীঘ্রই ঘর বানাবে। পরদিন কাঠমিস্ত্রি এনে টিন দিয়ে আগের চেয়েও আরো বেশ সুন্দর করে একটা ঘর বানালো। কোথায় মুরগীটাকে জবাই করে ভুড়ি ভোজের গোপন ষড়যন¿¿ ছিলো, সেখানে তার ¯হায়ীত্ত্ব আরো মজবুত করলো শুভ। ওর মনে পড়ে যায় সক্রেটিসের একটা কথা- “নিজেকে জানো ”। অদ্ভুত কান্ড- মুরগীটা নিজেকে জেনেছে ! তাই বোধহয় শুভও তাকে জানার সুযোগ পেয়েছে।
আর শুভ ? সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে কখনো জানার চেষ্টা করেনি। নদী কর্তৃক তার হৃদয় ভাঙার সাথে সাথে সব ভুলে গেলো সে। ভুলে গেলো ভালোবাসার ভিত্তির ভিটা টুকুও। পাষাণের মতো সব স্মৃতি ধ্বংস করতে লাগলো সে। শুভ’র আজ কেবলি বার বার মনে হচ্ছে, মুরগীটার মতো সে ও যদি নিজেকে জানতো...! তাহলে নিশ্চয়’ই তার ভাঙা হৃদয়টা কেউ না কেউ নতুন করে গড়ে দিতো।
নির্জন সুন্দর গ্রাম। গড়াই নদীর পাশে প্রকান্ড একটা বাড়ী। বাড়ীটিও গ্রামের মতো নির্জন এবং সুন্দর। পুরনো আমলের টিনের তৈরী ঘর। ঘরের চারদিকে বারান্দা। বিভিন্ন প্রজাতীর ফুল ও ফলের গাছগুলো ঘিরে রেখেছে বাড়ীটি।
বাড়ীর পেছনের বট গাছটায় দু’টা কোকিল দীর্ঘক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। শুভ লক্ষ্য করলো , একটা কোকিল বট গাছটার মগ ডালে বসে ডাকছে - আরেকটি গাছের নীচে বসে ডাকছে। কন্ঠস¦র দু’টা দু’রকমের। গাছে বসে যে কোকিলটা ডাকছে তার কন্ঠটা মধুর। আর গাছের নীচে বসে যে কোকিলটা ডাকছে তার কন্ঠটাও মধুর ; তবে শুধু মধুর। এখানে ‘খুব’ শব্দটি প্রয়োগ করা চলে না।
শুভ বিষয়টি নিয়ে কিছুটা কৌতুহলী হয়ে উঠলো। সে বিনা অনুমতিতেই বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়লো। ও ভীরু ভীরু পায় এগিয়ে যায় বট গাছটার দিকে। কুউ..কুউ.. ডাকরত বট গাছের ডালে বসা কোকিলটাকে দেখা যাচ্ছে না। গাছের নীচে বসা কোকিলটাকে দেখা যাচ্ছে।
থ হয়ে পড়ে শুভ! এ কোকিলটাতো মানুষ! স্বয়ং অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। দেশের বিশিষ্ট সাইকিয়াটিষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছর অবসর নিয়েছেন। এখন এ বাড়ীটাতেই একা বাস করছেন তিনি। স্ত্রী পুত্র-কন্যারা দেশের বাইরে অব¯হান করছে। শুভ তিন’শ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে কুষ্টিয়ার এই শান্দিয়ারা গ্রামে উনার কাছেই এসেছে।
শুভ মোশাররফ সাহেবের কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মোশাররফ সাহেব তার পাশে অপরিচিত একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি কোকিলটার ডাকের পর পর’ই উত্তর দিয়ে চলেছেন।
ঃ কুউ কুউ...
ঃ কুউ কুউ...
এক সময় কোকিলটা থেমে যায়। সাথে সাথে থেমে যান মোশাররফ সাহেবও। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এ সুযোগে শুভ মোশাররফ সাহেবকে ছালাম দিলো। তিনি ছালামের কোনো উত্তর দিলেন না। শুভ কিছুটা ভয়ের সুরে বললো, স্যার আমি কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছি। আমার নাম শুভ , শুভ আহমেদ।
ঃ আপনি কোথ্থেকে এসেছেন, তা কি আমি জানতে চেয়েছি ?
ঃ না স্যার ।
ঃ আপনার নাম শুনতে চেয়েছি ?
ঃ না।
ঃ তাহলে এসব বললেন কেন ?
ঃ ইয়ে..মানে স্যার আমি একটা সমস্যায় পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনার একটা পরামর্শ চাই স্যার।
ঃ দেখছেন না আমি এখন একটা কোকিল। বনের পাখি আপনাকে কি পরামর্শ দেবে ?
ঃ স্যার আমার সমস্যাটা বড় জটিল। দয়া করে একটু শুনুন। একটা বিরাট সমস্যা নিয়ে এসেছি।
ঃ আপনি কি দেশের প্রধানমন্ত্রী ?
ঃ না স্যার, একজন নাগরিক।
ঃ এমন নাগরিকের একটা সমস্যা কেন, এক হাজার সমস্যাও আমাদের দেশে তেমন জটিল কোন বিষয নয়।
ঃ কথাটা ভুল বললেন স্যার। প্রজা থেকেই কিন্তুু রাজার সৃষ্টি। কাজে’ই প্রজার সমস্যাটা’ই আসল। আমার সমস্যাটা আপনার শোনা প্রয়োজন স্যার। মহা সমস্যায় আছি।
ঃ হ্যাঁ, আপনি ঠিক’ই বলেছেন। কথাটা আমি ভুল’ই বলেছি । আপনি এ পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলায় ভুল কিছু বলেননি। কাজে’ই আপনি যে সমস্যায় আছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস-এর সমাধান আপনি নিজেই করতে পারবেন। আপনি এখন আসুন।
ঃ আমার কথাতে কি স্যার রাগ করেছেন ?
ঃ না রাগ হয়নি। বিরক্তিবোধ করছি।
ঃ তাহলে স্যার আমি অন্য একদিন আসি।
ঃ না, কখনো আমার কাছে আসতে হবে না। নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করা উচিৎ। এই শক্তি প্রত্যেককেই দেওয়া হয়েছে। অযথা আপনি তিন’শ কিলোমিটার দূর থেকে কষ্ট করে আমার এখানে এসেছেন।
হঠাৎ কাঁচ ভাঙার মতো একটা শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালেন মোশাররফ সাহেব। একটা বিড়াল ইদানীং খুব জালাচ্ছে। টেবিলে রাখা সব জিনিস পত্র নীচে ফেলে দেয় বিড়ালটি। চশমাটা টেবিলে রাখা ছিলো, মনে হয় তা ভেঙ্গে ফেলেছে। মোশাররফ সাহেব ঘরে গিয়ে দেখেন-চশমা ঠিক’ই আছে।
শুভ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, স্যারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য। এ সময় মোশাররফ সাহেব বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারটায় বসলেন। যুবকটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে এবার তিনি সত্যি সত্যি কিছুটা রাগান্বিত হলেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলেন। ভেতরে এসে তিনি আবারও কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনলেন। চশমাটা তিনি বারান্দায় নিয়ে গিয়েছিলেন- ইজি চেয়ারের সামনে টি টেবিলে রেখে এসেছেন। এবার বোধহয় বিড়ালটি চশমাটা ভেঙে’ই ফেলেছে। মোশাররফ সাহেব দৌঁড়ে গিয়ে দেখেন, না চশমা-টশমা কিছু’ই ভাঙেনি। বিষয়টি নিয়ে তিনি একটু সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। ঘরের কোথাও কাঁচের কোনো কিছু ভাঙলো কি না দেখতে লাগলেন। না, সব ঠিক আছে। তাহলে কাঁচ ভাঙার মতো এমন শব্দটা এলো কোথা থেকে...? বয়স হয়েছে, এই ভেবে শব্দ ভ্রম বলে বিষয়টি বাদ দিলেন তিনি।
যুবকটি এখনো দাঁড়িয়ে। মনে হয় সে তার সমস্যার কথাটি না বলে যাবে না । মোশাররফ সাহেব অনীচ্ছা সত্তে¦ও যুবকটিকে একটা কিছু বলে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য জানতে চায়লেন তার সমস্যার কথাটি।
শুভ চেয়ারে বসলো। মোশাররফ সাহেব কোথায় তাকে জলদি বিদায় করার জন্য চিন্তায় আছেন-সেখানে যুবকটি আসন পেতে বসেছে। একটু পরেই আবার কোকিলটা ডাকতে শুরু করবে ...
ঃ স্যার আমার সমস্যাটা হচ্ছে , আমার বুকের ভেতর প্রায়’ই কাঁচ ভাঙার মতো একটা শব্দ হয়।
মোশাররফ সাহেব চমকে উঠে জানতে চায়লেন, কি বললেন !
ঃ বুকে কাঁচ ভাঙার শব্দ হয়।
ঃ আমার এখানে আসার পর কি এমন শব্দ হয়েছে ?
ঃ জ্বি স্যার দুই বার।
আবারো চমকে উঠলেন মোশাররফ সাহেব! তিনি নিজের কানে শুনেছেন এই শব্দ।
বেশ কিছুদিন হলো এই বাড়ীটা কিনেছেন তিনি। এখানে তিনি পশু-পাখির ভাষা এবং মানুষের না বলা কথা বোঝার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে কি গবেষণার অগ্রগতি হতে শুরু করেছে..? যুবকটির বুকে কাঁচ ভাঙার যে শব্দ হয়েছে, তিনি তা শুনতে পেয়েছেন। কোকিলটা ডাকতে শুরু করেছে। না, আজ কোকিল নিয়ে নয় ; যুবকটিকে নিয়ে ভাবা জরুরী।
ঃ শুভ সাহেব, আপনি কি করেন-আইমিন আপনার পেশা কি ?
ঃ ব্যবসা। আর মাঝে মধ্যে একটু-আধটু কবিতা লিখি। পত্রিকায় তা ছাপাও হয়।
ঃ কাঁচ জাতীয় কোনো ব্যবসা ?
ঃ না স্যার।
ঃ ও আচ্ছা। ও হ্যাঁ,কবিতা লেখেন বললেন- তো এই মূহুর্তে কি কবিতা লিখতে পারবেন ?
ঃ পারবো স্যার। এক্রাকিউজ মি, আমাকে একটা কলম আর একটু কাগজ দিন প্লীজ।
মোশাররফ সাহেব কাগজ কলম আনতে ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কাগজ কলম নিয়ে এলেন। সাথে করে মাটির একটা পেয়ালায় কিছু মুড়িও আনলেন।
ঃ ইয়্যংম্যান এই নিন কাগজ কলম। কবিতা লিখুন আর মুড়ি চিবান।
শুভ মুড়ি খেলো না। সে কবিতা লিখতে মনোনিবেশ করলো।
মোশাররফ সাহেব শুকনো মুড়ি মচ মচ শব্দ করে চিবোতে লাগলেন। এসময় আবার তিনি কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনলেন। শুভ’র কবিতা লেখায় ডিষ্ট্রাব হবে বলে কিছু বললেন না।
ঃ স্যার , এইতো এইমাত্র কাঁচ ভাঙার শব্দ হয়েছে।
ঃ হ্যাঁ, আমি শুনতে পেয়েছি। আপনি কবিতা লিখুন।
ঃ স্যার, আপনি আমার এই শব্দ শুনতে পেয়েছেন !
ঃ ইয়েস, এর আগেও দু’বার শুনেছি।
ঃ কি বলছেন স্যার! অবাক ব্যাপারতো! তাহলে এর একটা সমাধান দিন স্যার। আর সইতে পারছি না। ওহ্ কি যে এক অসহ্য যণ¿না ...
ঃ আপনি লেখাটা শেষ করুন। না পারলে বাদ দিন।
ঃ এই নিন স্যার-
আমার সব আছে সব
নেই শুধু তুমি
তুমিহীনা আমি বড় একা
সব পেয়েও নিঃস্ব
আমি এক কষ্টের পৃথিবীতে
নীরবে বাস করছি
যা কেউ জানে না।
মোশাররফ সাহেব কবিতাটি পাঁচবার পড়লেন। তিনি এই প্রথম কোনো লেখা এতোবার পড়লেন।
ঃ আচ্ছা একজন মানুষের জন্য আপনি নিঃস্ব,পৃথিবীটা কষ্টের..হোয়াই ?
ঃ এটাতো স্যার কবিতা।
ঃ তাহলে কবিতাটি কি আপনি মিথ্যা লিখেছেন ? আপনি কি মিথ্যাবাদী কবি ?
ঃ না স্যার, আমি মিথ্যা বলি না।
ঃ শুধু কবিতায় বলেন।
ঃ না আমি মিথ্যা বলিনি। কবিতার বিষয়টি সত্য। তবে যাকে নিয়ে লেখা তাকে কেনো যেনো লুকানোর চেষ্টা করেছিলাম।
ঃ মূল বিষয় লুকানোর চেষ্টা করলে শুধু কাঁচ ভাঙার শব্দ কেনো , আপনার ভেতর একদিন জাহাজ ভাঙার শব্দ শুরু হবে। সত্যি করে বলুন , সেই তুমি আই মিন আপনার প্রেমিকাকে আপনি খুন করেছেন! খুন করে পালাবার সময় জানালা ভেঙে বেরুনোয় কাঁচ ভাঙার যে শব্দ হয়েছে- তা আজো আপনার ভেতরে রয়ে গেছে। যা প্রায়’ই শুনতে পাচ্ছেন।
ঃ ইম্পসিবল
আমি কখনো মুরগী‘ই জবাই করিনি।
ঃ শুভ সাহেব, আমি পুলিশ নই জাষ্টিজও নই। এছাড়া আইনজীবিও নই যে আপনাকে আমি জেরা করছি। কাজেই আমার কাছে সত্য প্রকাশ করলে আপনার জেল-ফাঁসি কিছুই হবে না।
ঃ স্যার আপনি যাকে খুন করার কথা বলছেন সে জীবিত। অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে ওর। গুলশানে পাঁচ তলা বাড়ি আছে তার।
ঃ ওর কয় তলা বাড়ি আছে নাকি টুইন টাওয়ার আছে সেটা আমার জানার বিষয় নয়। মেয়েটির নাম কি ?
ঃ নদী।
ঃ পদ্মা না মেঘনা ?
ঃ নাদিয়া ইসলাম নদী।
ঃ থ্যাংক ইউ। নদীর সাথে আপনার ঘটনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলুন। ও হ্যাঁ, অতিরিক্ত কিছু বলবেন না। ওকে ?
ঃ ওকে স্যার।
শুভ ঘটনাটি বলতে শুরু করলো। এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে এখনো কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোশাররফ সাহেবের ক্ষুধার পাশাপাশি ঘুমও পেয়েছে ভীষণ। কোনটাই করতে পারছেন না তিনি। আবার বিষয়টি উড়িয়েও দিতে পারছেন না। কাঁচ ভাঙার শব্দ তিনি নিজের কানে শুনেছেন। দীর্ঘ প্রায় দুই ঘন্টা ধরে ঘটনার বর্ননা করলো শুভ। এখন উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। মোশাররফ সাহেব কোন কথা বলছেন না। শুভ লক্ষ্য করলো, স্যার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘটনাটি তাকে আবার বলতে হবে। ক্ষুধা লেগেছে প্রচন্ড। শুভ টেবিলে রাখা মুড়ি চিবাতে লাগলো।
কাঁচ ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো মোশাররফ সাহেবের। শুভ সাহেব, শুকনো মুড়ি খেতে অসুবিধা হচ্ছে ?
ঃ না স্যার।
ঃ ওকে। ঘরে খেজুরের গুড় অবশ্য ছিলো, কিন্তু তালা খুলে আলমীরা থেকে তা আনতে দেরী হবে বলে আনা হয়নি।
ঃ স্যার আমার ঘটনাটি আপনি শেষের অংশটুকু শুনতে পারেননি- ঘুমিয়ে পড়েছিলেন । আমি সেই অংশটি আবার শুরু করছি ...
ঃ না, আপনাকে ফের বলার প্রয়োজন নেই। আমার মনে হচ্ছে, একটা সূত্র পেয়েই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মিঃ শুভ, আপনি যখন নদীর হাতে হাত রেখে শপথ করেছিলেন তখন তার হাতে কি চুড়ি পড়া ছিলো ? কাঁচের চুড়ি ?
ঃ জ্বি ছিলো।
ঃ সে সময় কি নদীর হাতের চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল ?
ঃ জ্বি জ্বি স্যার ভেঙে ছিল। তবে তার চুড়িটি আমি ভাঙিনি নদীও ভাঙেনি। হঠাৎ একটি ক্রিকেট বল এসে পড়লো নদীর হাতে। মাঠের পাশে একদল কিশোর ক্রিকেট...
ঃ ব্যাস, যেভাবেই ভাঙুক-নদীর চুড়ি সেদিন ভেঙেছিলো। আর সেই সাথে সাথে ক’দিন পর ভেঙে গিয়েছিলো আপনাদের শপথ। রাইট ?
ঃ জ্বি স্যার।
ঃ মানুষ মানুষকে কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারাটা এক জাতীয় খুন। হ্নদয় খুন। আপনি নদীর হ্নদয় খুন করেছেন। আপনার ভেতরে কাঁচ ভাঙার শব্দ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হচ্ছে, আপনার সেই শব্দ আমি কি করে শুনতে পারলাম!
কাঁচ ভাঙার শব্দের পাশপাশি এবার হঠাৎ বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুরু হয়েছে শুভ’র মাঝে। কখনো টিপ টিপ আবার কখনো ঝুম বৃষ্টি। এ শব্দটি ভীষণ ভালো লাগে ওর। এক দুঃষহ কষ্টের শব্দের মাঝে হঠাৎ ভাল লাগার এই অদ্ভ’ত শব্দের নেপথ্যে যে উদয় হলো, শুভ নিজেই তা আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
’সুলক্ষ্মী’। হালকা শারীরিক গঠনের একটা মেয়ে। গায়ের রংয়ে যেনো জোছনার আলো ছড়ানো। কথায় এবং মননে যাদুর অসাধারণ ছোঁয়া রয়েছে তার। ওর চোখ দু’টি যেনো পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলে। তার হাসিতে হ্নদয়ে ঝড় বয়ে যায়। সে এক সর্বনাশা মধুর ঝড়। এ্ই মেয়েটির কথা মনে পড়লেই শুভ’র ভেতরে টিপ টিপ বৃষ্টি...আর তার চোখে চোখ পড়লেই ঝুম বৃষ্টির শব্দ শুরু হয়। তখন মনে হয়, শুভ বৃষ্টিস্নাত এক অন্য মানুষ। বৃষ্টির এই শব্দটি সে আমৃত্যু ধরে রাখতে চায়। কিন্তু কোথায় যেনো একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয় এতে। কাঁচের দেয়াল। শেষ পর্যন্ত আর সাহস হয় না সুলক্ষ্মীর সামনে এই কথা নিয়ে দাঁড়াতে। অথচ শুভ’র গভীর বিশ্বাস- সুলক্ষ্মীর দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ালে তাকে শূণ্য হাতে ফিরিয়ে দিবে না। প্রকৃতির অমীয় সৃষ্টি বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা থেকে তাকে বঞ্চিত করবে না। তবুও ভয়। আর এই ভয় থেকেই যেনো সুলক্ষীর প্রতি আরো গভীরতার ভূ-স্বর্গ খনন হচ্ছে প্রতিদিন।
কাঁচ ভাঙার অসহ্য শব্দের মাঝে ভাল লাগার বৃষ্টির শব্দ-এটা নিশ্চয় প্রকৃতির সারপ্রাইজ। প্রকৃতি ধৈর্য্যশীলকে কখনো‘ই নিরাশ করে না। হয়তো এই সত্যটি প্রমাণের জন্যে’ই শুভ’র মেঘলা আকাশে নতুন সূর্যোদয়। সূর্যের এ আলোয় সে তেজদীপ্ত হবে নাকি পুড়ে অঙ্গার হবে- ভেবে পায় না। তবে এতে তেজদীপ্ত হলেও বৃষ্টির শব্দ-পুড়লেও বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায় সে। শংকা হয়-অতি বর্ষণে আবার প্লাবন ঘটে যায় যদি কিংবা ভয়ংকর ঢেউয়ের গর্জন! বিষয়টি নিয়ে সাইকিয়াষ্ট অধ্যাপক মোশাররফ সাহেবের সাথে কথা বলা জরুরী।
রাত বারটার কাঁটা অতিক্রম করে চলেছে। শুভ দরজায় কড়া নাড়তে যাবে,ঠিক এ সময় তার চোখ পড়লো একটি চিরকুটের দিকে - দরজায় কসটেপ দিয়ে আটকানো চিরকুটে লাল কালি দিয়ে লেখা-
“রাত বারটার পর কেয়ামত ঘটে গেলেও
আমাকে ডাক দেওয়া নিষেধ”
-অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন
কঠিন এই নিষেধাজ্ঞার কারনে কড়া নাড়তে সাহস পেল না শুভ। দরজার পাশে টিকটিকির মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে।
রেলগাড়ী চলার ঝিক ঝিক একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে ...। মোমবাতির আলো টিনের বেড়ার একটা ফুটো দিয়ে বাইরে আসছে। মোশাররফ সাহেব নিশ্চয় সজাগ। কি করছেন তিনি ? হয়তো জরুরী কোনো গুরুত্বপূর্র্ন কাজে ব্যস্ত । তো রেলগাড়ীর শব্দ আসছে কেন ? আশে পাশে কোথাও কোনো রেল ষ্টেশন নেই। এখান থেকে রেল ষ্টেশনের দূরত্ব প্রয় চৌদ্দ/পনের কিলোমিটার হবে। এতো দূর থেকে শব্দ আসার কথা নয়। শব্দটা আসছে এই ঘরের ভেতর থেকেই। শুভ’র ইচ্ছে করছে ফুটোটা দিয়ে ভেতরে তাকাতে। কিন্তু এটা সম্পূর্ন অনাধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়ে যায়। তবুও ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে তার। অবশেষে নিয়মনীতি ভঙ্গ করে শুভ ফুটোতে চোখ রাখলো।
রেল গাড়ী চলার ঝিক ঝিক শব্দের রহস্য দেখে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে ওর। বেশ কষ্ট করে অবরোধ করতে হচ্ছে তাকে।
দেশের বিশিষ্ট সাইকিয়াষ্ট অধ্যাপক মোশাররফ সাহেব আশি বছরের এই বৃদ্ধ বিছানায় বসে একটা খেলনা গাড়ি চালাচ্ছেন। প্লাষ্টিকের তৈরী দু’ফুট জায়গায় সীমাবদ্ধ গোলাকার রেল লাইনের মধ্যে ব্যাটারি চালিত রেলগাড়ী চলছে। বিষয়টি দারুণ উপভোগ করছেন তিনি। হঠাৎ রেলগাড়ি থেমে যায়। ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
ট্রেন থেমে যাওয়ায় মোশাররফ সাহেবের মনটা বেশ খারাপ হয়ে পড়েছে। তিনি দেয়াল ঘড়ি থেকে ব্যাটারি খুলে এনে রেলগড়িতে লাগালেন। রেল গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে - ঝিক ঝিক...
আনন্দে অধ্যাপক মোশাররফ সাহেবের চোখ-মুখ অবুঝ শিশুর মতো রূপ ধারণ করলো। শুভ মোশাররফ সাহেবের এই কান্ড দেখে অবাক হয়ে ভিন্ন এক আনন্দ উপভোগ করছে। কিছুক্ষণ পর আবারো ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়। থেমে যায় রেল গাড়ি। মোশাররফ সাহেব খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়ার মতো করে রইলেন। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বন্ধ দেয়াল ঘড়িটার দিকে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ভীষণ ধরে গেছে শুভ’র। ও পা টেনে টেনে বারান্দার সম্মূখে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘড়িতে রাত বারটা বেজে বিয়াল্লিশ মিনিট। কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল সে। এতো রাতে অচেনা-অজানা এই জায়গায় বাইরে কিভাবে যে একা কাটাবে,ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ এলাকাটি আলোকিত হয়ে উঠলো। জোছনার আলোয় পথ-ঘাট গড়াই নদীর জল সব ঝলছে উঠলো। নদীর জলগুলো রূপার মতো চক চক করছে। শুভ নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। স্বচ্ছ জলে আকাশটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
জলে ভেসে উঠেছে সপ্তর্ষী পূর্নিমার চাঁদ খন্ড খন্ড কিছু সাদা-কালো মেঘ। অদ্ভূত সুন্দর লাগছে এখন রাতের পরিবেশ। শুভ ঘাসের উপর আরাম করে বসলো। ব্যাগ থেকে বেনসনের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে রাখলো। দেয়াশলাই না থাকায় সিগারেটটি ধরানো যাচ্ছে না। মোশাররফ সাহেবের ঘরে এখনো মোমবাতি জ্বলছে। ইচ্ছে করলে ওখান থেকে সিগারেটটিতে আগুন ধরিয়ে আনা যায়। না,তা সম্ভব নয়। কেয়ামত ঘটে গেলেও উনার দরজায় কড়া নাড়া যাবে না।
শুভ আগুনবিহীন সিগারেটেই টান দিতে লাগলো। নিকোটিনের গন্ধ আসছে কিছু কিছু। মন্ধ লাগছে না ধোঁয়াবিহীন নিকোটিন পান । সে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জলে। কিছুক্ষন পর জলে ভেসে উঠলো নদী। সাথে সাথে শুভ’র ভেতরে শুরু হলো কাঁচ ভাঙার শব্দ- ঝন ঝন ....... ও উঠে দাঁড়াতে চায়লে নদী কথা বলে উঠলো-
ঃ শুভ, তুমি উঠবে না। বসো, তোমার সাথে কথা বলি। কেমন আছো তুমি ?
শুভ নিরুত্তর। সে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।
ঃ তুমি আমায় চিনতে পারোনি শুভ...
ঃ চিনবো না কেন ? তুমিতো দেখতে সেই আগের মতোই আছো।
ঃ তাহলে আমাকে দেখে চলে যেতে চায়লে যে ..
শুভ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, তোমার কথা মনে পড়লেই আমার ভেতরে কাঁচ ভাঙার শব্দ হয়- আমি সইতে পারি না।
ঃ বেশতো , আমায় ভুলে যাও।
ঃ ভুলে যাবো ?
ঃ হ্যাঁ, ভুলে যাবে। যে স্মৃতি মানুষকে কষ্ট দেয় , তা ভুলে যাওয়ায় ভালো।
ঃ তুমি পেরেছো ?
ঃ না, পারিনি। তবে তা সহ্য করে নিয়েছি। শুভ জানো, পৃথিবীটা অনেক বড়। তুমি অযথা আমার কথা মনে রেখে শুধু শুধু’ই কষ্ট লালন করছো। ’তুমি’ আর ’আমি’ এই বলয় থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাস্তার পাশের ঐ উলঙ্গ শিশুটি, বস্তিতে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃতে্যুর পথযাত্রী ঐ বৃদ্ধকেও আপন ভাবতে হবে।
একটা শুকনো ডাল আম গাছ থেকে ভেঙে পড়লো জলে। জলে গোলাকার একটা ক্ষুদ্র ঢেউয়ে কেঁপে কেঁপে অদৃশ্য হয়ে যায় নদী। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে পড়ে জল। এবার শান্ত জলে ভেসে উঠে সুলক্ষ্মীর প্রতিচ্ছবি। সাথে সাথে শুভ’র ভেতর শুরু হলো টিপ টিপ টাপুর টুপুর বৃষ্টি..। ওর চোখে যখন তার চোখ পড়লো অমনি ঝুম বৃষ্টির শব্দ.। শুভ কোনো কথা বলছে না। কথা বলছে না সুলক্ষ্মীও। শুভ ভাবছে-আচ্ছা, সুলক্ষ্মীর ভেতরেও কি তার মতো এমন প্রশান্তির বৃষ্টিপাত হয়..? অন্তত: ছিটে ফোটা দু’একটি...জিজ্ঞাসা করা যাক। না, থাক।
শুভ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,কেমন আছো সুলক্ষ্মী ?
সুলক্ষ্মী নিরুত্তর। ঠোঁটে তার অদ্ভুত হাসি।
শুভ একাই বলতে লাগলো- জানো সুলক্ষ্মী, এতোদিন কাঁচ ভাঙার কি যে এক অসহ্য শব্দে অতীষ্ট ছিলাম আমি! তুমি’ই আমার মাঝে বৃষ্টি পড়ার রিমঝিম শব্দের সৃষ্টি করলে। তোমার সাথে আমার দেখাটা আরো আগেই হলো না কেন ? অনেক আগে!
কথাগুলো শুনে সুলক্ষ্মী আরো অদ্ভুত ভাবে হাসতে লাগলো। যদিও হাসির কোনো শব্দ নেই, তবুও একটা শব্দ শুভ’র বুকে বর্ষার মতো বিদ্ধ করছে। ওর ইচ্ছে করছে জল ছুঁয়ে দেখতে। মেয়েটি তার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত জীবনের সব কিছুই নাড়িয়ে দিয়েছে। তার কেবলি মনে হচ্ছে- সে সুলক্ষ্মীর মতো’ই একজনের অপেক্ষা করছিলো।
জলে এখন সুলক্ষ্মী শব্দ করে হাসছে। শুভ জল ছুঁতে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাবে- এ সময় পেছন থেকে একজন তার কাঁধে হাত রাখলো। কিছুটা কেঁপে উঠে শুভ। পেছনে তাকিয়ে দেখে, অধ্যাপক মোশাররফ সাহেব।
ঃ স্যার,আস্আলামুআলাইকুম।
ঃ অলাইকুমআস্সালাম। তুমিতো এসেছো সেই কখন। তো আমায় ডাকলে না কেন ?
ঃ না, মানে এম্নি স্যার।
ঃ এম্নি বলছো কেন-চিরকুটে নিষেধাজ্ঞা দেখে তুমি আমায় ডাকোনি।
ঃ জ্বি স্যার। আচ্ছা স্যার, এমন কঠিন কথাটি লিখেছেন কেন ?
ঃ তোমার জন্য।
ঃ আ মা র জন্য ?
ঃ হ্যাঁ তোমার জন্য। আমার ধারণা ছিলো-তুমি আবার আমার কাছে আসবে। আসবে’ই। আর এ জন্যে’ই একটা ফাঁদ পেতে রেখে ছিলাম। যেনো তোমার আগমনের খবরটি আমি তোমাকে না দেখেই কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনে বুঝতে পারি।
ঃ এক্রকিউজ মি স্যার,আমিতো দিনের বেলা কিংবা রাত বারটার আগেও এখানে আসতে পারতাম।
ঃ হ্যাঁ, তা পারতে। তবে আমার কেন যেন মনে হয়েছিলো- তুমি আমার কাছে রাতেই আসবে এবং মধ্যরাতে। যাক সে কথা। কাঁচ ভাঙার শব্দের পাশাপাশি ইদানীং তোমার ভেতর যে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুরু হয়েছে, এতে আমি দারুন খুশী হয়েছি।
ঃ বৃষ্টি পড়ার শব্দও আপনি শুনেছেন স্যার !!
ঃ প্রথমে টিপ টিপ অত:পর ঝুম বৃষ্টি।
ঃ কি বলছেন স্যার !
ঃ খুব অবাক হচ্ছো,তাই না ?
ঃ জ্বি স্যার। এ কি করে সম্ভব ?
ঃ এসো ওখানটায় বসি। শোনো, আকাশে না তাকিয়েও তুমি এতোক্ষণ নদীর জলে পূর্ণিমার চাঁদকে দেখেছো। কাঁচওয়ালী - বৃষ্টিওয়ালীকে দেখেছো, তাদের সাথে কথা বলেছো। এটা যদি সম্ভব হয়-তাহলে আমার বিষয়টিও অসম্ভব কিছু নয়। আসলে মানুষের অসাধ্য বলতে কিছু নেই। বিজ্ঞানী নীল আর্মষ্ট্রং’এর মা-বাবাও বিশ্বাস করতেন যে, চাঁদে জিন পরী ও ভ’ত বসবাস করে। কিন্তু আর্মষ্ট্রং চাঁদে গিয়ে তার মা-বাবা এমনকি পৃথিবীর সবাইকে সেই বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে দিলেন। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, চাঁদে ভ’ত নয় ; বরং সেখানে মানুষ বসবাস করবে অচিরেই। মঙ্গলেও এই চিন্তা ভাবনা চলছে। তবে মানুষের মন জয় করা বড় কঠিন - চাঁদ এবং মঙ্গল আরোহনের চেয়েও। যাক তুমি কারো মন জয় করতে পারো আর না পারো- নিরবে একটা প্রশান্তির শব্দতো শুনতে পারছো। প্রথমে টিপ টিপ অত:পর ঝুম বৃষ্টি..। বৃষ্টিওয়ালীর নাম কি ? আষাঢ় না শ্রাবন ?
ঃ সুলক্ষ্মী।
ঃ বাহ্ ভিন্ন ঋতু!
ঃ স্যার, আমি এই বৃষ্টির শব্দটা ধরে রাখতে চাই।
ঃ বেশতো রাখবে। বৃষ্টির পানিতো আর্সেনিক মুক্ত।
ঃ কিন্তু কিভাবে যে তা ধরে রাখবো বুঝতে পারছি না। আমি কি করতে পারি স্যার ?
ঃ তুমি কি করবে আমি কি বলবো ? ধরো, সাপের কারনে তুমি কোনো রাস্তায় হাঁটতে ভয় পাচ্ছো-এ জন্যে তুমি আমার কাছে এলে একটা পরামর্শের জন্য। আমি তোমাকে কার্বোলিক এসিড নিয়ে ঐ রাস্তায় চলতে বললাম। তুমি তাই করলে। সাপ থেকে হয়তো রক্ষা পেলে, কিন্তু সেই রাস্তায় যদি অন্য কোনো জন্তু থাকে ? কাজেই বুঝতে পারছো তোমাকেই চিন্তা করতে হবে তুমি কি করবে। এ শক্তি পৃথিবীর সব মানুষকেই দেওয়া হয়েছে। শুভ’র আঙ্গুলের ফাঁকে সিগরেটটা এখনো রয়েছে। দীর্ঘক্ষণ আঙ্গুলে থাকায় তা নেতিয়ে পড়েছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মোশাররফ সাহেব বললেন, মিঃ শুভ সিগারেট হবে একটা ?
শুভ লজ্জিত ভাবে বললো, জ্বি হবে স্যার। কিন্তু আগুন নেই স্যার।
ঃ দাও দেখি একটা। তোমার মতো আমিও নিকোটিনের গন্ধ পান করি।
শুভ সিগরেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলো। মেশাররফ সাহেব নিজে একটা নিলেন আরেকটি শুভকে দিলেন। দু’জনে আগুনবিহীন সিগারেট আয়েশ করে টানতে লাগলো।
পাখি ডাকতে শুরু করেছে। ভোর হতে আর বেশী সময় বাকী নেই। মোশাররফ সাহেব লক্ষ্য করলেন, আবারো বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শুভ গভীর ভাবে চেয়ে আছে নদীর জলে। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, শুভ’র ভেতরে কাঁচ ভাঙার শব্দ আর হয়নি এ পর্যন্ত। তবে কি এ শব্দটা থেমে গেছে ? থেমে যাওয়াই ভালো। বেচারা অন্যদের মতো নিরবে ধ্বংস হতে চায় না। সে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চায়। ঈশ্বরও মনে হয় তার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চান। আর এ জন্যে’ই তার ভেতরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ সৃষ্টি করে দিয়েছেন তিনি। ধরাজ গলায় শুভ বললো,এইতো এই মাত্র বৃষ্টির শব্দ হলো - শুনেছেন স্যার ?
মোশাররফ সাহেব শুভ’র কাঁধে দ্বিতীয়বার হাত রেখে বললেন, শুনেছি। মিঃ শুভ,এ নিয়ে তুমি কখনো দুঃচিন্তা করো না। আমার ধারণা, প্রকৃতি তোমাকে পছন্দ করেছে। তুমি সুলক্ষীর বিষয়টি প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দাও। যা করার প্রকৃতি’ই করুক। আমাদের জীবনতো আর অনন্ত কালের জন্য নয় যে, কষ্ট এলে তা অনাদীকাল বহন করতে হবে। জীবের মৃত্যু যেহেতু অবধারিত- তো অবশেষে না হয় মৃত্যু’ই সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। এসো, আমরা সবাই মৃত্যুকে ভয় নয় ; ভালোবাসতে শিখি। মানুষের জীবনে মৃত্যু’ই সবচেয়ে সুন্দর!
ভোরের মিষ্টি হাওয়া পাখির ডাক আর বৃষ্টি পড়ার অদৃশ্য রিম ঝিম শব্দে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে’ই সূর্যোদয় হচ্ছে। সূর্যের তাজা আলোর স্পর্ষ নিতে গড়াই নদীর তীরে বসে আছে শুভ। পাশে রয়েছেন দেশের বিশিষ্ট সাইকিয়াষ্ট অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। তিনি তৃতীয় বারের মতো শুভ’র কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমার লেখা কবিতা শোনাও।
শুভ তার লেখা কবিতা পড়া শুরু করলো-
সুলক্ষ্মী,
আমার বৃষ্টি পড়ার শব্দ
ফুসুফুসের অক্রিজেন
বুকের ধক ধক
মস্তিস্কের ঘূণ পোকা
ভোরের মিষ্টি হাওয়া
অলস দুপুরের সংগীত
বিকেলের মধুর হাসি
গোধূলীর অদ্ভুত রং
সন্ধ্যার সপ্তর্ষী
জোসনার রূপালী আলো
রাতের রেড ওয়াইন
অদৃশ্য ফুলের গন্ধ
কেমন আছো তুমি ?
তুমি ভালো থেকো
খুব ভালো ।